জেমস আব্দুর রহিম রানা : যশোরের মনিরামপুরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আয়া পদে চাকরি না পেয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে জুতা পিটা করেছেন এক নারী। অভিযোগ, মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হক স্থানীয় খাকুন্দি গ্রামের কুলসুম বেগমকে আয়া পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে চাকরি না দিয়ে আসমা খাতুন নামে মনোহরপুর ইউপির সংরক্ষিত নারী সদস্যকে (১,২ ও ৩) চাকরি দিয়েছেন।
শুধু জুতা মেরে থামেননি কুলসুম বেগম সভাপতি সিরাজুল ইসলামের অনিয়মের বিচারের দাবিতে গ্রামবাসীকে জড়ো করে সমাবেশও করেছেন। শনিবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে শত শত গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি কালীপদ মন্ডল,
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ওয়াজেদ আলী সরদার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড শেখর বিশ্বাস, হালিম সরদার, দাতা সদস্য ওয়াদুদ মোড়ল, কোমর গাজী, দাতা সদস্য আলী আজম বাচ্চু, মহিতোষ বিশ্বাস, আতাউর রহমান, আব্দুস সাত্তার সরদার, সোবাহান বিশ্বাস প্রমুখ।
ভুক্তভোগী কুলসুম বেগম বলেন, আমার শ্বশুর মান্দার মোড়লের জমিতে স্কুল। জমি দানের সময় শর্ত ছিল বিদ্যালয়ে কোন পদ খালি হলে যোগ্যতা অনুযায়ী দাতা মান্দার মোড়লের পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি দিতে হবে। আমরা সে অনুযায়ী আয়া (শূণ্য পদে) আবেদন করেছিলাম। দাতা পরিবার হলেও চাকরি দেওয়ার কথা বলে সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হক ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। সভাপতি নিয়েছেন ৩ লাখ আর প্রধান শিক্ষক ৩ লাখ।
কুলসুম বেগম বলেন, চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সভাপতি আমাকে দিয়ে তাঁর বাড়ি আয়ার কাজ করিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) মনিরামপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড বসে। বোর্ড বসার আগে সভাপতি ১ লাখ টাকা নেয়। পরে শুনি আমারে চাকরি না দিয়ে ইউপি মেম্বর আসমা খাতুনকে চাকরি দেছেন।
কুলসুম বেগম বলেন, চাকরি না পেয়ে শুক্রবার সকালে কাচারিবাড়ি মোড়ে সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে পেয়ে আমি তার কাছে টাকা চাই। তখন তিনি আমার সাথে খারাপ আচরণ করলে আমি জুতা খুলে তাকে মারি।
সিরাজুল ইসলাম মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ৬-৭ বছর আগে তিনি অবসরে যান। এরপর দেড় বছর ধরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম ইতিপূর্বে মনোহরপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
কুলসুম বেগম বলেন, নিয়োগ বোর্ডের আগের রাতে আমার বাড়ি প্রশ্ন পৌঁছে দেন সভাপতি। আমার পদে পাঁচজন পরীক্ষা দেছেন। আমি ছাড়া বাকি কারও আবেদন করা ছিল না। বিনা আবেদনে ১১ লাখ টাকা নিয়ে আসমা খাতুনকে চাকরি দেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চারটি শূন্যপদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে একাধিক প্রার্থীর নিকট থেকে অর্থ বাণিজ্য শুরু করেন বিদ্যালয়ের সভাপতি। তার সাথে সহযোগিতা করেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিয়াদ হোসেন, সহকারী শিক্ষক ইমদাদুল হক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম। তারা একাধিক প্রার্থীকে চাকুরী দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা বাণিজ্য করেন। একপর্যায়ে অধিক পরিমান টাকার বিনিময়ে আয়া পদে আবেদন বিহীন প্রার্থী ইউপি সদস্য আসমা বেগম ও দপ্তরি পদে সভাপতির আপন চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলীসহ সভাপতির আস্থাভাজন চারজনের নিয়োগ চুড়ান্ত করেন। এরপরই একাধিক প্রার্থীর নিকট থেকে অর্থবাণিজ্যের বিষয়টি জানাজানি হয়।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত অভিযুক্ত ও মারপিটের শিকার হওয়া ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাষ্টার সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, বিদ্যালয়ের চারজন কর্মচারী নিয়োগে কোন অর্থ বাণিজ্য করা হয়নি। সকল পদে প্রার্থীদের আবেদন যাচাইবাছাই শেষে যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বরং ইতোপূর্বে একাধিক বার স্থানীয় কিছু ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে রেখেছিল। যা মোটা অংকের অর্থনৈতিক লেনদেনের বিনিময়ে ছাড় করানো লেগেছে। তিনি বলেন, আমি শুনেছি বিদ্যালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাওলানা ইমদাদুল হক আয়া পদে আবেদনকারী কুলছুম আকতারের নিকট থেকে অগ্রিম দুই লাখ টাকা নিয়েছেন। তবে আমি সেই লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত নই।
তিনি বলেন, সকালে আমি বাজার থেকে হেঁটে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে চাকরি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রার্থী কুলছুম আকতার আমার উপর চড়াও হয়ে আমাকে হেনস্তা করেছে এটা সত্যি। যেহেতু তাকে আমরা নিয়োগ দিতে পারিনি সেহেতু তার রাগ অভিমান থাকতেই পারে। কিন্তু টাকার লেনদেনের যে অভিযোগ আমার নামে করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার প্রতিপক্ষ এসব খারাপ কথা রটাচ্ছেন। আমি কারো কাছ থেকে টাকা নিইনি।
স্থানীয় আব্দুস সাত্তার বলেন, সভাপতিকে ওই নারী আমার সামনে জুতা দিয়ে পিটিয়েছেন।
ওয়াজেদ আলী নামে বতর্মান ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য বলেন, এ কমিটি স্কুলটা শেষ করে দিলো। আমরা এই কমিটি বাতিল সহ বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
মনোহরপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি কালিপদ মণ্ডল বলেন, স্কুল কমিটির অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ফুঁসে উঠে সমাবেশ ডেকেছে।
ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমি এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল পূর্বক অসহায় কুলছুম আক্তারকে আয়া পদে নিয়োগ দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।
মনোহরপুর ইউপি চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, স্কুলের সভাপতি টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ায় এক নারী তাঁকে জুতা দিয়ে পিটেছে বলে শুনেছি।
এ ব্যাপারে জানতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র সরকারের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হয়েছে। তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।